ভৌতিক গল্প : "চুপচাপ বাড়িটা"

ভৌতিক গল্প : "চুপচাপ বাড়িটা"

সাবিকের বয়স মাত্র দশ বছর। ওর বাবা একটা নতুন চাকরির জন্য শহরের একদম প্রান্তে একটা পুরনো বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। বাড়িটা দেখতে খুব সুন্দর, কিন্তু আশপাশের লোকজন সেটা এড়িয়ে চলে। কেউ বলে, “ওই বাড়িটার একটা ইতিহাস আছে”, কেউ বলে, “রাতে ওখানে আলো জ্বলে, অথচ কেউ থাকে না”।

সাবিক এসব কথায় বিশ্বাস করে না। তার কাছে এসব পুরোটাই গুজব। নতুন স্কুল, নতুন বন্ধু আর বিশাল একটা বাড়ি—সবকিছু নিয়ে সে বেশ উৎসাহী ছিল।

কিন্তু প্রথম রাতেই কিছু অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো।

রাত তখন আনুমানিক তিনটা। হঠাৎ সাবিকের ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে তীব্র বাতাস বইছে, আর জানালার কাচ কাঁপছে। সে উঠে বসে। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো—সে শুনতে পেল, কারো কণ্ঠস্বর নিচের ঘর থেকে আসছে।

"চুপ করে থাকো... সে জেগে উঠবে..."

সাবিক ভয় পেয়ে গেলো। সে জানে বাবা-মা দুজনেই ঘুমিয়ে আছেন। তাহলে এই আওয়াজ কার?

সে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে গেলো। কান পেতে শুনলো—আরো একটা আওয়াজ,

"তুমি এখনও ওখানেই আছো?"

সাবিক বুঝতে পারলো, এটা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। সে সাহস করে দরজা খুলে নিচে নামলো। আলো জ্বালাতে গিয়েও থেমে গেলো—ঘর থেকে ক্ষীণ আলো বেরোচ্ছে, অথচ কেউ আলো জ্বালায়নি।

বসার ঘরের কোণায় রাখা একটা পুরনো চেয়ার নিজে নিজেই দুলছে।

তার সামনে হঠাৎ এক ছায়ামূর্তি ভেসে উঠলো—একটা ছোট্ট মেয়ে, বয়স বড়জোর আট বা নয় বছর। তার চোখে জল, গলায় ফাঁসির দাগ।

"আমাকে বের করে দাও... আমি আটকে আছি..."

সাবিক চিৎকার করে উঠলো, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো না। সে দৌড়ে উপরে চলে গেলো, মায়ের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো।

পরদিন সকালে সে কাউকে কিছু বলতে পারলো না। মা-বাবা কিছু বুঝতে না পেরে ভাবলেন, ও বুঝি নতুন পরিবেশে একটু ভয় পেয়েছে।

কিন্তু পরদিন রাতেও একই ঘটনা। এবার সেই মেয়েটি সাবিকের নাম ধরে ডাকলো।

"সাবিক... তুমি কি আমাকে দেখতে পাও?"

সে জানালো, তার নাম লিজা। অনেক বছর আগে এই বাড়িতে তার পরিবার থাকতো। একদিন হঠাৎ করে আগুন লেগে যায়, কিন্তু সবাইকে উদ্ধার করা গেলেও লিজা হারিয়ে যায়। কেউ তাকে খুঁজে পায়নি।

"আমি এখানে আটকে আছি, সাবিক। কেউ আমার কথা শোনে না। তুমি পারো আমাকে মুক্তি দিতে।"

সাবিক বুঝতে পারলো, মেয়েটির আত্মা শান্তি খুঁজছে।

তৃতীয় রাত সে নিজেই মেয়েটির দেখানো পথে অনুসরণ করে নিচের ঘরের এক কোণে ছোট একটা কাঠের জানালা খুঁজে পায়। সেটা খুলতেই বেরিয়ে আসে পুরনো একটা ডায়রি আর এক জোড়া পুতুল।

ডায়রিতে লেখা—

"যদি কেউ এই পুতুল দুটো একসাথে কবর দেয়, তবে আমি মুক্তি পাবো।"

সাবিক সে রাতেই লুকিয়ে বাইরে যায়, বাড়ির পেছনে বাগানের মাটিতে ছোট গর্ত করে পুতুল দুটো কবর দেয়।

হঠাৎ বাতাস থেমে যায়, গাছের পাতা স্তব্ধ। আকাশে একফালি চাঁদ—আর সেখানে দাঁড়িয়ে আছে লিজা। তার মুখে এক ফোঁটা হাসি।

"ধন্যবাদ, সাবিক। তুমি আমায় মুক্তি দিলে।"

সেই রাতের পর আর কখনোই বাড়িটা নিয়ে কেউ কিছু বলেনি। সাবিকও আর কিছু অনুভব করেনি।

তবে মাঝে মাঝে, সে জানালার পাশে বসে দেখতে পায়—একটা ছোট্ট চেহারা, হাসিমুখে হাত নাড়ছে।

Post a Comment

0 Comments